হাড় ভাঙ্গা (Fracture)
আঘাতের কারণে বা রোগাক্রান্ত হয়ে, হাড় ভেঙ্গে যাওয়াকে অস্থিভাঙ্গা বা হাড় ভাঙ্গা বা ফ্র্যাকচার বলে।
হাড়ের ভাঙ্গন বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন-
- সহজ বা আবৃত ভাঙ্গন
- যৌগিক বা অনাবৃত ভাঙ্গন
সহজ বা আবৃত ভাঙ্গন
যদি দেহের আহত স্থানের চামড়া বা মাংস পেশি অক্ষত থাকে এবং হাড়ের ভাঙ্গা অংশ বাহিরের (বাতাসের সংস্পর্শে) সঙ্গে কোনো প্রকার সংযোগ স্থাপন না করে, তাকে সহজ বা আবৃত ভঙ্গন ভলে।
যৌগিক বা অনাবৃত ভাঙ্গন
যদি দেহের আহত স্থানের চামড়া বা মাংস পেশিতে ক্ষত হয় এবং ভাঙ্গা হাড় শরীরের বাহিরের (বাতাসের সংস্পর্শে) সঙ্গে উক্ত ক্ষত দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করে, তবে তাকে যৌগিক বা অনাবৃত ভঙ্গন বলে।
এক্ষেত্রে ক্ষতে জীবানু সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং এ ধরনের ভাঙ্গা রোগের চিকিৎসাও ঝুঁকিপূর্ণ।
আবার ভাঙ্গার প্রকৃতি অনুযায়ী হাড়ের ভাঙ্গাকে কয়েকভাবে শ্রেনী বিন্যাস করা যায়, যেমন-
- আড়াআড়ি ভাঙ্গা
- কোনাকুনি ভাঙ্গা
- স্পাইরাল ফ্রাকচার
- কমিউনিটেড ফ্রাকচার
- কম্প্রেসড ফ্রাকচার
- গ্রীন্সটিক ফ্রাকচার
- বাকলিং ফ্রাকচার
হাড় ভাঙ্গার লক্ষণঃ
- আঘাতের ইতিহাস থাকবে।
- ব্যথা হবে। নাড়াচড়া করলে ভাঙ্গার স্থানে বেশি ব্যথা অনুভুত হবে।
- আহত অঙ্গের কার্যকারিতা বা কর্মক্ষমতা কমে যাবে।
- রোগীর অঙ্গ বিকৃতি হতে পারে।
- মাংস পেশির সংকোচনের জন্য একটা হাড়ের খন্ড অপর খন্ডের উপরে চলে যেয়ে অঙ্গের খর্বাকৃতি হতে পারে।
- ভাঙ্গা অংশ ফোলে যাবে।
- ভাঙ্গা অংশে চাপ দিলে ব্যথা হবে।
- উপরিভাগের চামড়াতে কালশিরা বা ফোস্কা দেখা যাবে।
- কিছু অস্থি ভঙ্গের ক্ষেত্রে ভাঙ্গার উপরে ক্ষত থাকতে পারে।
- ভাঙ্গার পরবর্তী অংশে রক্ত সঞ্চালন ও স্নায়ুর পরিবহন ঠিক থাকতেও পারে আবার নাও ঠিক থাকতেও পারে।
- পরীক্ষা করলে ভাঙ্গার স্থানে ক্রিপিটাস শব্দ পাওয়া যাবে এবং খড়খড়ে (গ্রিটি) অনুভুতি হবে ইত্যাদি।
অস্থিভঙ্গ চিকিৎসার মূলনীতি (Principles of Fracture Treatment):
- দূর্ঘটনা স্থানে রোগীদের হাড়ভাঙ্গার চিকিৎসা পরে করতে হয়।
- প্রথমে রোগীর শ্বাসনালী পরিষ্কার কিনা দেখতে হবে। যাতে সহজে সে শ্বাস নিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
- কোনো অঙ্গে রক্তপাত হতে থাকলে তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে টুর্নিকেট(tourniquet) বা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
- ক্ষত অংশ পরিষ্কার করে, পরিষ্কার কাপড় দিয়ে আবৃত করতে হবে।
- রোগীর নাড়ীর গতি (পালস) দেখতে হবে।
- এরপর দেখতে হবে রোগীর শরীরের কোন অংশের হাড় ভেঙ্গেছে কিনা?
- দেখতে হবে হাড় ভাঙ্গাটা কোন ধরনের সহজ বা আবৃত ভাঙ্গণ নাকি যৌগিক বা অনাবৃত ভাঙ্গন তা নিশ্চিত করতে হবে।
- রোগীকে নাড়াচড়া করার সময় রোগীর আহত অঙ্গটিকে হাত দিয়ে টানের উপর রাখতে হবে। যেন ভাঙ্গা অংশ খুব বেশি নাড়াচড়া না হয়।
- খুব বেশি নাড়াচড়া হলে রক্তনালী, স্নায়ু, মাংশ পেশি ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- হাত পা ভাঙ্গলে ভাঙ্গা অংশের দুই পাশে সোজা চটি বা কাঠ দিয়ে বেঁধে নেয়া যেতে পারে।
- মেরুদন্ডের হাড় ভাঙ্গলে বিশেষ করে ঘাড়ের নিকট ভাঙ্গলে অন্তত তিন জন লোক মিলে অত্যন্ত সাবধানের সহিত ভাঙ্গা অংশ নিশ্চল (Immobilize) করে রোগিকে স্থানান্তর করতে হবে। যেমন, একজন মাথা, একজন ঘাড় ও একজন কোমর ধরে একটি গাছের গুড়ির মতন করে সরাতে হবে।
- ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।
- টিটেনাসের প্রতিষেধক দিতে হবে।
- রোগী যদি শকে থাকে তবে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে এবং রক্ত দেওয়া সহ সকল চিকিৎসার জন্য দ্রুত ৯৯৯ এ কল করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
হাড় ভাঙ্গার প্রাথমিক চিকিৎসা (Primary Treatment of Fracture):
- এ ক্ষেত্রে প্রথমে ভাঙ্গা খন্ডদ্বয় কে স্বাভাবিক অবস্থায় আনায়ন বা পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করতে হবে। সাধারণত এটি দুইজন দুইদিকে টান দিয়ে করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ট্রাকশনের প্রয়োজন হয়। তবে এটি ট্রেনিং ছাড়া করা যায় না।
- অনেক সময় ট্রাকশনে কাজ না হলে,অপারেশন করে প্লেট, স্ক্রু লাগিয়ে জোড়া ঠিক রাখতে হয়।
- তবে এক্স-রে করে হাড় পুনঃস্থাপন করাই উচিৎ।
সহজ বা আবৃত ভাঙ্গার চিকিৎসা
সহজ বা আবৃত ভাঙ্গার ক্ষেত্রে নিশ্চলকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার। ৩ কারণে ভাঙ্গা অংশ সমূহের নিশ্চলকরণ (Immobilization) প্রয়োজন পড়ে,যেমন-
১। ভাঙ্গা অংশের স্থানচ্যুতি বা কৌনিকাত (২০০ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য) ঠিক করার জন্য।
২। ভাঙ্গা খন্ডসমূহের মধ্যে নাড়াচড়া বন্ধ করার জন্য। নাড়াচড়া হলে জোড়া লাগার প্রক্রিয়ায় বাঁধা সৃষ্টি হয়।
৩। ব্যথা দূর করার জন্য।
তবে রিব (শিনার হাড়), ক্ল্যাভিকল (কলার/ কন্ঠ অস্থি), স্ক্যাপুলা (পাখনার হাড়) ইত্যাদি নিশ্চলকরন ছাড়া জোড়া লাগে।
নিশ্চলকরন (Immobilization) করার পদ্ধতিঃ
- প্লাস্টার অব প্যারিস (পিওপ), কাষ্ট বা অন্যান্য স্প্লিন্ট দ্বারা।
- সার্বক্ষনিক টানের দ্বারা
- প্লেট, স্ক্রু, রড (Plate, Screw, Nail) ইত্যাদি দ্বারা
যৌগিক বা অনাবৃত ভাঙ্গার চিকিতসাঃ
যৌগিক বা অনাবৃত ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে পরিষ্কার পানি বা নরমাল স্যালাইন দিয়ে ক্ষত ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে। - হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা বিটাডিন দিয়ে ড্রেসিং দেয়া যেতে পারে।
- টিটেনাসের প্রতিষেধক দিতে হবে।
- মনে রাখবেন, হাড় ভাঙ্গার পরে ঝাঁড়-ফু, কবিরাজি না করিয়ে দ্রুত ৯৯৯ এ কল করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
পরামর্শঃ
যে কোনোভাবে হাড় ভেঙ্গে গেলে তা নিশ্চিত হয়ে, প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অতি দ্রুত একজন অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ বা হাসপাতালে রোগী প্রেরণ করতে হবে।
চিকিৎসকরা এক্স-রে সহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগীর পরবর্তী চিকিৎসা শুরু করবেন। যদি রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ না থাকে এবং প্লাস্টার করে দিলে মোটামুটি ঝুকিমুক্ত থাকেন তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শে রোগী বাসায় চলে যেতে পারবে। আর যদি রোগীর অবস্থা খুবই শংকটাপন্ন থাকে এমনকি অপারেশনেরও প্রয়োজন হতে পারে তাহলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা নিজেরা চিকিৎসা করবেন অথবা উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সুপার স্পেশালইজড হাসপাতালে প্রেরণ করবেন।
প্লাস্টার, প্লেট, স্ক্রু, রড থাকা কালিন মাংস পেশি শুকিয়ে যাওয়া এবং প্লাস্টার, প্লেট, স্ক্রু, রড ইত্যাদি খোলার পরে জয়েন্ট লক হয়ে যাওয়ার জন্য ফিজিওথেরাপি গ্রহণ করবেন।