প্রবীনদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফিজিওথেরাপি

0
792
প্রবীনদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফিজিওথেরাপি
প্রবীনদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফিজিওথেরাপি

 

প্রবীনদের কাছে ফিজিওথেরাপি খুবই পরিচিত একটি নাম ৷ আমাদের দেশের অনেক প্রবীন এখন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিচ্ছেন ৷ কারণ প্রবীনরাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে থাকেন ৷ জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে বাংলাদেশে প্রবীনদের সংখ্যা ও দিন দিন বাড়ছে ৷ সাধারণত ৬০ বছর বা তার অধিক বয়সের জনগোষ্ঠীকে প্রবীন বলা হয় ৷ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ প্রবীন অর্থাৎ প্রায় ১.৫০ কোটির কাছাকাছি যা আগামীতে আরো কয়েক কোটিতে গিয়ে দাড়াবে ৷ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব অনেক বেশি ৷

বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবীনদের যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়ঃ

১৷ বাত-ব্যাথা বা অর্থ্রাইটিস, কোমর, ঘাড়, হাঁটু ও অন্যান্য জয়েন্ট এর ব্যাথার প্রবণতা বাড়তে থাকে ৷

২৷ শরীরের মাংসপেশী দুর্বল হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে শরীরের কাঠামোগত পরিবর্তন দেখা দেয় ৷ যার ফলে শরীর সামনের দিকে ঝুকে যায় বা কুজো হয়ে যায় অপর দিকে হাঁটা চলাফেরার ভারসাম্য ও কমে যায় ৷

৩৷ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, হৃদরোগ ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগের আশংকা বাড়তে থাকে ৷

৪৷ স্নায়ু জনিত বিভিন্ন সমস্যা (যেমন- স্ট্রোক বা প্যারালাইসিস, নিউরোপ্যাথি, পারফিনসন বা হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়া ও চলাফেরার ধীরগতি) দেখা দেয়।

৫। স্থুলতা বা মুটিয়ে যাওয়া, ও হাড়ের ক্ষয়রোগ বা অষ্টিও পরোসিস হতে পারে।

৬। পেলভিক ফ্লোর ডিসফাঙ্কশন দেখা দেয়। অর্থাৎ আমাদের কোমরের মাংশপেশী (যা আমাদের প্রজনন অঙ্গগুলোকে ধরে রাখে) দুর্বল হয়ে যায়। যার ফলে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, বার বার প্রস্রাব করা, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা এমনকি কোমর ব্যাথাও হয় ।

৭। ধীরে ধীরে আত্নবিশ্বাস কমে যায় ও বিষন্যতা অনুভব করে ।

প্রবীনদের সেবায় ফিজিওথেরাপির গুরুত্বঃ

প্রবীনদের বার্ধক্য জনিত অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা ই প্রতিরোধ করা বা কমিয়ে আনা সম্ভব। একজন দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা, রোগের লক্ষন-ধরন বিবেচনা করে রোগীর জন্য সঠিক ও নিরাপদ মাত্রার থেরাপিউটিক ব্যায়াম নির্ধারন করেন ।

১। ফিজিওথেরাপি জয়েন্ট ও মাংশপেশীর ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে । বাত- ব্যাথা বা আর্থ্রাইটিস এর ফলে জয়েন্ট এর শক্তভাব বা বিকলাঙ্গতা প্রতিরোধ করে ।

২। দুর্বল মাংশপেশীর শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে কুজো হওয়ার প্রবনতা দুর করে এবং হাঁটা-চলাফেরার ভারসাম্য বজায় রাখে।

৩। বিশেষ ধরনের থেরাপিউটিক ব্যায়াম ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। ফিজিওথেরাপি চিকিসৎক রোগীর টার্গেট হা্র্টরেট, রক্তচাপ ও শরীরের ওজন পরিমাপ করে রোগীর জন্য সঠিক মাত্রায় ব্যায়াম নির্বাচন করে দিবেন।

৪। স্নায়ুবিক বিভিন্ন সমস্যাই ফিজিওথেরাপি (যেমন- মুভিলাইজেশন, স্ট্রেচিং, স্ট্রেন্থেনিং, ব্যালেন্স ও কুঅর্ডিনেশন ট্রেনিং) খুবই কার্যকরী চিকিৎসা।

৫। পেলভিক ফ্লোর ডিসফাঙ্কশন রোগীদের জন্য পেলভিক ফ্লোর স্ট্রেন্থেনিং এক্সারসাইজ খুবই কার্যকরী। যার ফলে অনেক রোগী তার প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা ফিরে পায়।

৬। শ্বাস প্রশ্বাস জনিত বিভিন্ন সমস্যাই (যেমনঃ অ্যাজমা, সিওপিডি বা শাসকষ্টজনিত রোগ) এবং যাদের হৃদযন্তের অস্ত্রোপচার হয়েছে তাদের জন্য চেষ্ট ফিজিওথেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ন। চেষ্ট ফিজিওথেরাপি ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে ৷

৭৷ শারীরিক ও মানসিক প্রফুল্লতা আনয়ন করে ও কর্মক্ষম জীবন-যাপনে সাহায্য করে ৷

কিছু সাধারন ব্যয়ামঃ

কিছু সাধারন ব্যয়াম যা একজন সুস্থ্য-সবল প্রবীন নিয়মিত করতে পারবেন। তবে যাদের মেরুদন্ডের হাড়ের ডিস্কপ্রোলাপস, ক্ষয়রোগ এবং হৃদরোগী (যাদের হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার হয়েছে বা যাদের হার্টের পেস মেকার ও রিং লাগানো আছে) অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিষ্টের পরামর্শ মতেই যে কোন ব্যায়াম করবেন ৷

  • ডিপ ব্রেথিং (Deep Breathing): মেরুদন্ড সোজা করে বসে নাক দিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে ২-৩ সেকেন্ড ধরে রাখা, তারপর ধীরে ধীরে শ্বাস বের করে দেওয়া ৷ এভাবে পর পর ৪-৫ বার করে দিনে ২-৩ বার করতে পারবেন ৷

ঘাড় ডানে এবং বামে ঘুড়িয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা ৷ এ ভাবে ৫ বার করে প্রতি পাশেই দিনে অন্তত ১-২ বার করতে পারেন ৷ চিত্র (ক) তে দেখুন । মাথা ডানে ও বামে কাত করে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা ৷ এভাবে প্রতিপাশে ৫বার করে দিনে ১-২ বার ৷ চিত্র (খ) তে দেখুন ৷

ঘাড় ডানে এবং বামে ঘুড়িয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা
ঘাড় ডানে এবং বামে ঘুড়িয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা

 

"<yoastmark

  • মাথা সামনে পিছনে ঝুকিয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা এভাবে প্রতিপাশে ৫ বার করে দিনে ১-২ বার ৷ চিত্র (গ) তে দেখুন ৷

"<yoastmark

  • সোজা হয়ে বসে থুতনি ভিতরের দিকে চাপ দেওয়া । এভাবে ৫-১০ বার করে দিনে ১-২ বার করতে পারেন। চিত্র (ঘ) তে দেখুন ৷
সোজা হয়ে বসে থুতনি ভিতরের দিকে চাপ দেওয়া
সোজা হয়ে বসে থুতনি ভিতরের দিকে চাপ দেওয়া
  • কনুই সোজা করে হাত সামনের দিকে ৯০ ডিগ্রি উচু করে অপর হাত দিয়ে কব্জিতে উপরের দিকে এবং নিচের দিকে চাপ দিয় ২০-৩০ সেঃ ধরে রাখা এভাবে দুই হাতেই করতে হবে। চিত্র (ঙ) তে দেখুন ৷
কনুই সোজা করে কব্জিতে উপরের দিকে এবং নিচের দিকে চাপ দেওয়া
কনুই সোজা করে কব্জিতে উপরের দিকে এবং নিচের দিকে চাপ দেওয়া
  • সোজা হয়ে দাড়িয়ে পিঠের ত্রিকোনাকার হার দুটোকে ভিতরের দিকে চাপ দিয়ে ১০ সেঃ ধরে রেখে ৫ বার। এভাবে দিনে ১-২ বার করতে পারেন। চিত্র (চ) তে দেখুন ৷
সোজা হয়ে দাড়িয়ে পিঠের ত্রিকোনাকার হার দুটোকে ভিতরের দিকে চাপ দেওয়া
সোজা হয়ে দাড়িয়ে পিঠের ত্রিকোনাকার হার দুটোকে ভিতরের দিকে চাপ দেওয়া
  • চেয়ারে বসে কাধে হাত রেখে শরীর ডানে এবং বামে ঘুড়িয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা৷ এভাবে প্রতি পাশে ৫ বার করে দিনে ১-২ বার করতে পারেন। চিত্র (ছ) তে দেখুন ৷

"<yoastmark

  • কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে ধীরে ধীরে শরীর পিছনের দিকে চাপ দেওয়া ৷ এভাবে ৫-১০ বার করে দিনে ১-২ বার করতে পারেন। চিত্র (জ) তে দেখুন ৷

"<yoastmark

  • দেয়ালে ধরে দাড়িয়ে হাঁটু ভাজ করে এক পা সামনে এবং হাঁটু সোজা করে অপর পা পিছনে রেখে শরীর সামনের দিকে ঝুকানো, অবশ্যই খেয়াল রাখবেন পায়ের ঘুড়ালি যেন মেঝেতে থাকে ৷ এভাবে প্রতি পায়ে ১০ সেকেন্ড করে ৩ বার দিনে ১-২ বার করতে পারেন। ৷ চিত্র (ঝ)
দেওয়ালে চাপ দেওয়া
দেওয়ালে চাপ দেওয়া
  • এক পায়ের উপর দাড়িয়ে অপর পায়ের হাটু সোজা করে কোন উচু জায়গায় রেখে চাপ দিয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রাখা৷ এভাবে প্রতি পায়ে ১০ সেকেন্ড করে ৩ বার দিনে ১-২ বার করতে পারেন। ৷ চিত্র (ঞ)

"<yoastmark

  • এক পায়ের উপরে দাড়িয়ে ১০ সেকেন্ড থেকে পুনরায় অন্য পায়ে ১০ সেকেন্ড করে প্রতি পায়ে ১০ বার এভাবে দিনে ১-২ বার করতে পারেন। ৷ চিত্র (ট)

"<yoastmark

  • আঙ্গুলের উপর দাড়িয়ে ১০ সেকেন্ড করে ১০ বার এভাবে দিনে ১-২ বার করতে পারেন। ৷ চিত্র (ঠ)
আঙ্গুলের উপর দাড়িয়ে থাকা
আঙ্গুলের উপর দাড়িয়ে থাকা
  • মেঝেতে সোজা ও লম্বা দাগ টেনে তার উপর দিয়ে ৫ মিনিট হাটা, দিনে ১-২ বার করতে পারেন
  • তাছাড়াও স্ট্যাটিক সাইকেল চালানো ও সাতার কাটতে পারেন ১০-১৫ মিনিট করে সপ্তাহে ৩-৪ দিন ৷

শেষ কথাঃ
 প্রবীনদের সেবায় ফিজিওথেরাপি একটি নিরাপদ ও কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি ৷ প্রবীনদের সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন যাপনে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি সেবা প্রয়োজন ৷ তবে একজন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ফিজিওথেরাপিষ্টের কাছ থেকেই ফিজিওথেরাপি সেবা নিবেন ৷ তিনি আপনার জন্য প্রয়োজনীয় ও নিরাপদ মাত্রার থেরাপিউটিক ব্যায়াম নির্ধারন করে দিবেন। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ বিহীন অনুপযুক্ত ব্যয়াম করা থেকে দূরে থাকুন এবং সুস্থ থাকুন ৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here