ডাউন সিন্ড্রোম কি

0
967
ডাউন সিন্ড্রোম
ডাউন সিন্ড্রোম


ডাউন
সিন্ড্রোম কি
?
মানুষের দেহের প্রত্যেকটা কোষে নিউক্লিয়াস বিদ্যমান। আর নিউক্লিয়াসে থাকে ক্রোমোসোম। এই ক্রোমোসোমে জেনেটিক (বংশ বৃদ্ধির ধারক ও বাহক) উপাদান থাকে। এই ক্রোমোসোমের জীনগুলো উত্তরাধিকার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য দায়ী কোড বহন করে। প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াস ২৩ জোড়া(৪৬ টি) ক্রোমোসোম ধারন করে এবং যার অর্ধেক পিতা বা মাতার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়।
ডাউন সিন্ড্রোম হয়ে থাকে যখন ২১ নাম্বার ক্রোমোসোম জোড়ার  সঙ্গে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে আরেকটি ক্রোমোসোম (Trisomy 21) সন্নিবেশিত থাকে। এই অতিরিক্ত জেনেটিক উপাদানটি জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশে বাধা দেয় এবং ডাউন সিন্ড্রোমে সহায়তা করে।

ডাউন সিন্ড্রোমের আবিষ্কারঃ
১৯ শতকের পূর্বে মানুষ এই রোগটি সম্পর্কে কিছুই জানতো না। সর্বপ্রথম ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাঙ্গডন ডাউন এই রোগের রোগী চিহ্নিত করেন। উনার নাম অনুসারে ডাউন সিন্ড্রোম নামকরণ করা হয়। মি. ডাউন স্বতন্ত্র এবং আলাদা ভাবে এই রোগের অস্তিত্ব বর্ণনা করেন। এ জন্যই উনাকে ” ডাউন সিন্ড্রোমের জনক বলা হয়”। সাম্প্রতিক সময়ে ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুর বৈশিষ্ট্যগুলো বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের চিকিৎসক Jerome Lejeune শনাক্ত করেছেন যে, এটা একটা ক্রোমোসোমাল সিন্ড্রোম। প্রতিটা কোষের নিউক্লিয়াসে স্বাভাবিক ৪৬ টি ক্রোমোসোমের পরিবর্তে এই সিন্ড্রোমে ৪৭ টি ক্রোমোসোম দেখা যায়। এ ছাড়া ২১ নাম্বার ক্রোমোসমের সমস্যা হওয়ায় এই ডউন সিন্ড্রোম হয়ে থাকে।

বৈশিষ্ট্য

সাধারণ কিছু শারিরিক বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝা যায় যে, কোনো শিশু ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত কিনা। বৈশিষ্ট্য গুলো-

  • মাংসপেশির শিথিলতা।
  • বামন বা কম উচ্চতা।
  • চোখের কোনা উপরের দিকে উঠানো।
  • চেপ্টা নাক।
  • ছোট কান।
  • হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা।
  • জিহ্বা বের হয়ে থাকা ইত্যাদি।

    ডাউন সিন্ড্রোম
    ডাউন সিন্ড্রোম

ডাউন সিন্ড্রোমের হারঃ 
CDCP (Centers for Disease Control & Prevention) এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৭০০ শিশুর মধ্যে ১ টি ডাউন সিন্ড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহন করে। আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় ৬০০০ শিশু ডাউন সিন্ড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহন করে।

ডাউন সিন্ড্রোমের ধরণঃ 

৩ ধরনের ডাউন সিন্ড্রোম আছে

১। ট্রাইজমি ২১ (Trisomy 21)

২। ট্রেন্সলোকেশন (Translocation)

৩। মোসাইক (Mosaic)

 ট্রাইজমি ২১ (Trisomy 21)
এই ধরনের ডাউন সিন্ড্রোম সধারনত কোষ বিভাজনের অস্বাভিকতার কারনে হয়ে থাকে। একে ননডিসজাংশন বলা হয়। ননডিসজাংশনে ২১ নাম্বার ক্রোমোসমের ২টি কপির পরিবর্তে ৩টি কপি শুরু হবে। বন্ধনের ক্ষেত্রে ওই ক্রোমোসম শুক্রানু বা ডিম্বানুর সাথে যুক্ত হতে ব্যার্থ হয় এবং এই অতিরিক্ত ক্রোমোসোম অন্য কোষে রেপ্লিকেশন শুরু করে দেয়।
ডাউন সিন্ডোমের  মধ্যে ৯৫% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।
ট্রেন্সলোকেশন  (Translocation)
কোষের ৪৬টা ক্রোমোসোমের মধ্যে ২১ নাম্বার ক্রোমোসোমটি সম্পূর্ন বা আংশিক অন্য ক্রোমোসোমের (সাধারনত ১৪ নাম্বার ক্রোমোসোম) সাথে যুক্ত হয়।
ডাউন সিন্ডোমের মধ্যে ৪% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।
মোসাইক (Mosaic)
এইক্ষেত্রে ২ প্রকার কোষে মিশ্রণ ঘটে। কিছু কোষে ৪৬টি ক্রোমোসোম থাকে এবং কিছুতে থাকে ৪৭টি ক্রোমোসোম। এই ৪৭টি ক্রোমোসোমের মধ্যে ২১ নাম্বার ক্রোমোসোম অতিরিক্ত থাকে।
ডাউন সিন্ডোমের মধ্যে ১% রোগীর এই রোগ হয়ে থাকে ।

কি কারণে ডাউন শিশুর জন্ম হয়?
ঠিক কি কারণে মায়ের গর্ভে ডাউন সিন্ড্রোম শিশুর জন্ম হয় তা সম্পূর্ণ জানা যায়নি। তবে একথা প্রমাণিত যে, কোন নারী যত অধিক বয়সে মা হবেন, তার সন্তান ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হবার সম্ভাবনাও তত বেশী হবে। যেমন ২৫ বছর বয়সের প্রতি ১২০০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজন মায়ের ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে এবং ৩০ বছর বয়সের প্রতি ৯০০ জন মায়ের মধ্যে একজন মায়ের ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে, বয়সের সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে।
কিন্তু ৩৫ বছর বয়সের পর ঝুঁকি দ্রুত বাড়তে থাকে। ৩৫ বছর বয়সের প্রতি ৩৫০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজনের এবং ৪০ বছর বয়সের প্রতি ১০০ জন মায়ের একজনের ডাউন শিশু হতে পারে। তবে যে কোন বয়সের মায়ের ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে। অন্যদিকে কোন মায়ের আগে একটি ডাউন সিন্ড্রোম শিশু থাকলে পরবর্তীতে ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হবার সম্ভাবনা বাড়ে। এছাড়া-

  • পরিবেশ দূষণ,
  • গর্ভবতী মা ভেজাল খাদ্য গ্রহন ও প্রসাধনী গ্রহণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন সিন্ড্রোম শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারনা করা হয়।
  • অনেক সময় বাবা-মা ত্রুটি যুক্ত ক্রোমোজমের বাহক হলে তাদের  সন্তানও ডাউন সিন্ড্রোম শিশু হতে পারে।

পরাবর্তী সন্তানের ডাউন সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাব্যতাঃ
একজন মা যদি পূর্বে  ট্রাইজমি অথবা ট্রান্সলোকেশন রোগের মতন কোন সন্তান জন্ম দেয়, তাহলে তার পরবর্তী সন্তানের এ রোগ হওয়ার সম্ভাব্যতা বেশি।

ডায়াগনোসিসঃ 
একজন চিকিৎসক যে কোন বয়সের শিশুকে দেখেই ডাউন  সিন্ড্রোম  শিশু কিনা তা সন্দেহ করতে পারেন। কারন তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকে। বাবা মায়েরা যখন দেখেন তাদের  সন্তানের চেহারা একটু ভিন্ন ধরনের,  শিশুর গায়ে শক্তি কম, নির্ধারিত বয়সে বসতে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে শিখছেনা, শারীরিক বৃদ্ধি কম, কম বুদ্ধি সম্পন্ন, তখন তারা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হন। চিকিৎসক শিশুর রক্তের ক্রোমোসোম সংখ্যা বা ক্যারিওটাইপিং পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন  সিন্ড্রোম শিশু কিনা তা নিশ্চিত করেন।
১১ হতে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবতী মায়ের রক্তে প্যাপ-এ, এইচসিজি এবং ১৬ হতে ২০ সপ্তাহের মধ্যে এএফপি, ইসট্রিয়ল, এইচসিজি ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থের মাত্রা পরীক্ষা করে ডাউন সিন্ড্রোম  শিশুর জন্ম হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারনা করা যায়। তাছাড়া আল্ট্রাসনোগ্রাফী করে মায়ের পেটে ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের শিশুর ঘাড়ের পিছনের তরলের মাত্রা, নাকের হাড়ের উপস্থিতি, “ডাকটাস্ ভেনোসাস” নামক প্রাথমিক রক্তনালীর রক্তপ্রবাহ ইত্যাদি নির্নয়ের মাধ্যমেও ডাউন  সিন্ড্রোম  শিশু জন্ম নেয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত মায়েদেরকে ডাউন সিন্ড্রোম  শিশুর নিশ্চিত পরীক্ষা করার উপদেশ দেয়া হয়। গর্ভাবস্থার ১১ হতে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক গর্ভফুল হতে কোষকলা সংগ্রহের মাধ্যমে অথবা ১৫ হতে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের বাচ্চার চারপাশের তরল পদার্থ সংগ্রহের মাধ্যমে বাচ্চার DNA পরীক্ষা করে গর্ভের বাচ্চাটি ডাউন শিশু কি না তা ১০০ ভাগ নিশ্চিত করা যায়। এ সময় বাচ্চার আকার হয় প্রায় ২-৪ ইঞ্চির মতো। কাজেই রিপোর্ট অনুযায়ী বাবা-মা গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন

ডাউন সিন্ড্রোম বাচ্চার ক্ষেত্রে  সমাজের ভূমিকাঃ

ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে সামাজিক ভূমিক
সামাজিক ভূমিক


ডাউন সিন্ড্রোম রোগীদের সামাজিক এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে কার্যকর করার জন্য আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠান, স্কুল, স্বাস্থ্য সেবা, কর্মস্থল, বিনোদন ক্ষেত্র ইত্যাদি তৈরী করতে হবে। এ সব রোগীরা হালকা থেকে গুরুতর বিভিন্ন বিষয় বহন করে। এদের জ্ঞান হালকা থেকে মাঝারি ধরনের। চিকিৎসা প্রযুক্তির অগ্রগতির কারনে এ রোগের ব্যাক্তিরা আগের থেকে বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। ১৯১০ সালেও এ রোগীরা শুধু ১ম বছরের বেশি বাঁচতো না, কিন্ত এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কারনে গড় বয়স ১৯-২০ বছর পর্যন্ত বেড়ে যায়। ক্লিনিক্যাল চিকিৎসার উন্নতির কারনে ডাউন সিন্ড্রোমের ৮০% রোগীরা এখন ৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

পরামর্শঃ
যত দ্রুত সম্ভব শিশুকে পেডিয়াট্রিশিয়ান অথবা চাইল্ড নিউরোলজিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া। এ সমস্ত শিশুরা বিভিন্ন সমস্যায় ভোগে তাই তাদের সে সমস্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বিকাশের জন্য পরিচর্যা করা। এই জন্য অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, পেডিয়াট্রিশিয়ান ইত্যাদি হেলথ প্রফেশনালদের পরামর্শ গ্রহণ করবেন এবং শিশুকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন।
সেবা, প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে এই সমস্ত শিশুদের স্বাভাবিক শিশুদের মতো করে গড়ে তোলা উচিত। এদের প্রত্যেকের মাঝে লুকিয়ে আছে অফুরন্ত মেধা এবং কর্মশক্তি। সুতরাং আমরা যদি একটু সচেতন হই, তাদের বুঝতে চেষ্টা করি তাহলে তাদের সফলতার জন্য কোন বাঁধাই আর বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here