চিকুনগুনিয়া (Chikungunya)
চিকুনগুনিয়া একটি মশা বাহিত ভাইরাল রোগ যা প্রথম ১৯৫২ সালে দক্ষিণ তানজানিয়ায় একটি প্রাদুর্ভাবের সময় লক্ষ্য করা যায়। চিকুনগুনিয়া ঐসব মশার মাধ্যমে ছড়ায় যেসব মশা ডেঙ্গু ও জিকার মত রোগ সৃষ্টি করতে পারে। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, ভারতীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর, ক্যারিবিয়ান এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সাধারনত দেখা দেয়। তবে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা খুব কম তবে বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়া মৃত্যুর কারণ হতে পারে এবং এটি প্রায়শই অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সম্পর্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে চিকুনগুনিয়া ১০০ টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয়ের অভাবে, বিশ্বব্যাপী এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা অনুমান করা সম্ভব নয়।
কারনঃ
- চিকুনগুনিয়ার কারন হিসাবে ইজিপ্টি এবং অ্যালবোপিক্টাস উভয় প্রজাতির মশাকে দায়ি করা হয়।
এই দুই প্রজাতির মশা যেমন, ইজিপ্টি গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলের মধ্যে এবং অ্যালবোপিকটাস নাতিশীতোষ্ণ এমনকি ঠান্ডা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও রোগ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম ।
এই মশাগুলোকে দিনের আলোতে কামড়তে দেখা যায়, যদিও সকালে এবং বিকেলে এই মশাগুলো উচ্চ হারে ছড়িয়ে পরে। উভয় প্রজাতি মশা ঘরের বাইরে অথবা ঘরের ভিতরে কামড়ায়।
- সংক্রমিত মশার কামড়ের কারনে চিকুনগুনিয়া জ্বর হয়ে থাকে
- চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা কামড় দিলে এবং ঐ মশা যদি কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে কামড় দেয় তা হলে চিকুনগুনিয়া জ্বর হয়ে থাকে।
- চিকুনগুনিয়া উপদ্রব বেশি এমন জায়গায় ভ্রমণ করলে চিকুনগুনিয়া জ্বর হতে পারে
লক্ষণঃ
সংক্রমিত মশার কামড়ের ৩-৭ দিন পর সাধারণত উপসর্গ শুরু হয়।
সাধারণ লক্ষণ হলোঃ
- জ্বর (সাধারণত ১০২০ ফারেনহাইড)
- অস্থিসন্ধি ব্যথা (এটি সাধারণত কয়েক দিনের জন্য স্থায়ী হয় অথবা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরের জন্য দীর্ঘায়িত হতে পারে)
- জয়েন্ট ফুলে যাওয়া
- মাথাব্যথা
- বমি বমি ভাব
- পেশী ব্যথা
- ফুসকুড়ি
- ক্লান্তি
বেশিরভাগ রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে ভাল বোধ করেন। মাঝে মাঝে চক্ষু, স্নায়ু জনিত সমস্যা, হৃদরোগের এবং অন্ত্রের জটিলতাগুলি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণের সাথে জড়িত থাকতে পারে।
রোগ নির্ণয়ঃ
সংক্রমণের প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে ভাইরাসটি সরাসরি রক্তে সনাক্ত করা যেতে পারে।এছাড়াও চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এরমধ্যে সেরোলজিক্যাল পরীক্ষা, যেমন- এনজাইম-লিঙ্কড ইমিউনোসরবেন্ট অ্যাসেস (ELISA) এবং দুটি রিয়েল-টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন-পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (RT-PCR) টেস্ট ইত্যাদি।
চিকিৎসাঃ
চিকুনগুনিয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। ক্লিনিক্যাল ব্যবস্থাপনা প্রাথমিকভাবে উপসর্গগুলি উপশম করার লক্ষ্যে কাজ করে, যার মধ্যে রয়েছেঃ
- অ্যান্টি-পাইরেটিকস
- উপযুক্ত ব্যথানাশক
- প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা
- পরিমিত বিশ্রাম
চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গুর উপসর্গের মধ্যে মিল রেখে, যেসব এলাকায় উভয় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, সেসব স্থানে চিকুনগুনিয়ার সন্দেহভাজন রোগীদের অ্যাসপিরিন বা নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAID) ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে, যতক্ষণ না ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় করা হয় (কারণ ডেঙ্গুতে এইসব ওষুধ রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়)।
তবে অস্থি এবং মাংশ পেশিতে ব্যথার জন্য ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বেশ কার্যকর।
চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে টিকাঃ
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে এখনো কোন বাণিজ্যিক টিকা নেই। যদিও বেশ কয়েকটি দেশে টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে। যার মধ্যে কিছু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে, যা এখনও লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং জনসাধারণের নিকট পৌছাতে কয়েক বছর সময় লাগবে। মশার কামড় এড়িয়ে চলা সংক্রমণ প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ
- যদি আপনি জানেন যে আপনার চিকুনগুনিয়া আছে, অসুস্থতার প্রথম সপ্তাহে মশার কামড় এড়িয়ে চলুন। এই সময়ের মধ্যে ভাইরাস রক্তে সঞ্চালিত হতে পারে, এবং সেইজন্য আপনি ভাইরাসটিকে নতুন মশার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যা অন্যদের সংক্রামিত করতে পারে।
- মানুষের আবাস্থলে আশেপাশে মশার প্রজনন স্থানগুলির চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি এডিস মশা বা অন্যান্য রোগ সৃষ্টির একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। বর্তমানে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধের প্রধান পদ্ধতি হল মশার বাহকদের মোকাবেলা করা। মশার প্রজননকে বাড়ায় এমন প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম জলাধারের সংখ্যা হ্রাসের উপর চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ অনেকটা নির্ভর করে। মশার বংশবৃদ্ধি এবং পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্ক মশা উৎপাদনকে বাধাগ্রস্ত করতে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে জল ধারণকারী পাত্র খালি এবং পরিষ্কার করার জন্য সম্প্রদায়ের একত্রিতকরণ প্রয়োজন। মশার প্রজনন কমাতে সচেতন সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রনের একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে।
- প্রাদুর্ভাবের সময়, উড়ন্ত মশা মারার জন্য কীটনাশক স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে, যেসব পাত্রে মশা থাকে সেখানে এবং আশেপাশের কীটনাসক প্রয়োগ করতে হবে। মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
- চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের সময় সুরক্ষার জন্য, এমন পোশাকের পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে মশা ত্বকের সংস্পর্শ আসতে না পারে।
- যারা দিনের বেলা ঘুমায়, বিশেষ করে ছোট বাচ্চা, বা অসুস্থ বা বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য, মশারী ভাল সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কারণ চিকুনগুনিয়া বহনকারী মশাগুলি সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ভ্রমণকারী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রাথমিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং এর মধ্যে রয়েছে লম্বা হাতা জামা এবং প্যান্ট পরা এবং মশার প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য পর্দা বা জানালায় জাল ব্যবহার করা।
পরামর্শঃ
মশার প্রজনন প্রতিরোধঃ
- মশার ডিম পাড়ার আবাসস্থলে নষ্ট করে দেওয়া।
- বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলতে হবে।
- মশার জন্য মানবসৃষ্ট আবাসস্থল অপসারণ করতে হবে যেমনঃ ঝোপ জঞ্জাল, ফুলের টবে জমে থাকা পানি, বদ্ধ ড্রেন, টায়ারে জমে থাকা পানি, ছোট ছোট বদ্ধ ও অব্যবহৃত ঢোবা নালা ইত্যাদি।
- ঘর এবং ঘরের বাহিরে পানি সঞ্চয়কারী পাত্রে উপযুক্ত কীটনাশক প্রয়োগ।
সামাজিক সচেতনতা:
- মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সমজের সকলকে অবহিত করা।
- সমজের সকলকে একযোগে কাজ করতে উৎসাহিত করা। কারন সমজের সকলে নিজ নিজ বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার না করলে মশার উৎস নির্মূল করা সম্ভব নয়।
সরকারের হস্থক্ষেপঃ
- মশা দমনে সরকারকে সরাসরি হস্থক্ষেপ করতে হবে। বদ্ধ ড্রেন, নালা, ঢোবা ইত্যাদি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
- মশা জন্মাতে পারে এমন জায়গা গুলোতে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
- মশা নিদনের জন্য সকল ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্নভাবে জন-সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহযোগী গোষ্ঠীদের থেকে সাহায্য নিতে হবে।
ডেঙ্গু এবং চিকুগুনিয়ার মধ্যে পার্থক্যঃ
বৈশিষ্ট্য | ডেঙ্গু | চিকুনগুনিয়া |
১। ভাইরাসের প্রজাতি | ডেঙ্গু ভাইরাস, ফ্লাভিভাইরিডিয়া পরিবার এবং ফ্লাভিভাইরাস বংশের অন্তর্গত | চিকুনগুনিয়া ভাইরাস, টোগাভিরিডিয়া পরিবার এবং আলফা ভাইরাস বংশের অন্তর্গত |
২। প্রাথমিক ভেক্টর | এডিস ইজিপ্ট | এডিস অ্যালবোপিক্টাস |
৩। ইনকিউবেশন | ৪-৭ দিন | ৩-৭ দিন (পরিসর ১-১২ দিন) |
৪। রোগের সময়কাল | ৪-৭ সপ্তাহ | ১-২ সপ্তাহ |
৫। কমন লক্ষণ | জ্বর, মাথাব্যথা | জ্বর,মাথাব্যথা |
৬। জয়েন্ট এবং মাংশপেশিতে ব্যথা | · পিঠে ব্যথা
· বাহু এবং পায়ের পেশি ব্যথা · হাঁটু এবং কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা |
· হাতে-পায়ের সকল জয়েন্টে ব্যথা করে, এমনকি ব্যথায় জয়েন্ট ফুলে যায়।
· সকালের দিকে ব্যথা বেশি হয়। |
৭। ফুসকুড়ি | সাধারণত মুখে এবং হাত-পায়ে ফুসকুড়ি হয়। | ধর, হাত-পা, মুখ, তালুতে ফুসকুড়ি হয় ।
|
৮। বাত | অনুপস্থিত | উপস্থিত |
৯। রক্তক্ষরণ | উপস্থিত | উপস্থিত বা অনুপস্থিত উভয় হতে পারে |
১০। শক | রোগীর শক হতে পারে | সাধারণত শক হয় না |
১১। জটিলতা | প্রাণঘাতী জটিলতা যেমন- শক, শ্বাসকষ্ট এবং রক্তপাত হতে পারে। | ১০% পর্যন্ত রোগীদের দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্টে ব্যথা হয়, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে স্নায়ুবিক জটিলতা দেখা দেয়। |
Reference:
- https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/chikungunya
- Govt.Centers for Disease Control and Preventon. [Online] 2020. [Cited: Novembar 23, 2020.] https://www.cdc.gov.
- NHS.UK. [Online] 2019. [Cited: Auguest 08, 2019.] https://www.nhs.uk.