করোনা ভাইরাস
করোনা একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ ‘মুকুট’। বিজ্ঞানীরা অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে করোনা ভাইরাসের বাহিরের আবরণকে ‘মুকুট’ কিংবা ‘সূর্যের মতন’ দেখতে পেয়েছে। তাই এই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে করোনা ভাইরাস।
এই করোনা ভাইরাস ১৯৩০ সালের দিকে সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে এরা বিভিন্ন প্রাণিদের সংক্রমিত করতো বিশেষ করে ‘মুরগিদের’। কালের পরিক্রমায় এরা বিভিন্ন প্রাণিদের আক্রান্ত করা শুরু করে এবং নিজেদের ভ্যারিয়েন্ট বা প্রজাতির পরিবর্তন করতো। একটা সময় করোনা ভাইরাস SARS-CoV-2 নামক এক নতুন প্রজাতিতে পরিবর্তিত হয়। যা মানুষকে সংক্রমিত করতে সক্ষম। তাই যখন ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বার, করোনা ভাইরাসের নতুন প্রজাতি ‘চীনে’ মারাত্বক রূপ ধারণ করে, তখন বিজ্ঞানীরা একে ‘নোভেল করোনা ভাইরাস’ নামে নাম করন করেন। এই করোনা ভাইরাস একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস যা ২০১৯ সাল থেকে পুরু পৃথিবীতে মাহামারী রূপ ধারণ করে।
কোভিড-১৯
নোভেল করোনা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট রোগের নামকে কোভিড-১৯ নামে বিজ্ঞানীরা নামকরণ করেছেন। এই কোভিড-১৯, যেটি সাধারন স্বর্দি, কাশি থেকে শুরু হলেও, পরবর্তীতে অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম এর মতো মারাত্বক রোগ তৈরী করে।
বৃদ্ধ ব্যক্তি ও শিশুরা করোনা ভাইরাসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। যারা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত তাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। যুবক বয়সেও কোভিড-১৯ হতে পারে। এ রোগের চিকিৎসা এখনো মানুষের কাছে রহস্য। করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন প্রদানের মাধ্যমে সংক্রমণ হ্রাস করা সম্ভব। আমেরিকার এক গবেষনায় দেখা যায় কোনো ব্যক্তি যদি ভ্যাক্সিন না গ্রহন করে তাহলে, ভাইরাস জিনগত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে তাঁর দেহে অধিক সংক্রমণ এব্ং অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
কোভিড-১৯ এর লক্ষনঃ
কোভিড-১৯ এর খুব কমন লক্ষণ গুলো হল-
- জ্বর
- শুকনো কাশি
- শরীর দূর্বলতা
কোভিড-১৯ এর মাঝারি লক্ষণ গুলো হল-
- জ্বর (১০১-১০২ ডিগ্রি)
- শরীরে শিরশিরে ভাব (নিয়মিত কাঁপুনিসহ)
- ভারি কাশি
- শ্বাসকষ্ট (অক্সিজেন সেচুরেশন ৯৪% এর নীচে)
- ক্লান্তি ভাব
- শরীরে ব্যথা
- পেশীতে ব্যাথা
কোভিড-১৯ এর মারাত্বক/তীব্র লক্ষণ গুলো হল-
- শ্বাসকষ্ট হবে
- ক্ষুধা মন্দা বা খাবারে অরুচি
- হতবিহ্বলহওয়া বা কনফিউশন হওয়া
- বুকে স্থির একটা ব্যথা বা চাপ চাপ অনুভূতি হওয়া
- অনেক বেশি জ্বর হবে
- পানিশূন্য হয়ে পড়া
- বারবার বমি হতে থাকা
- অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা/বিভ্রান্তি/অর্ধচেতন/অবচেতন
এছাড়া অরো অনেক লক্ষণ আছে,তবে এই লক্ষণ গুলো সকলের ক্ষেত্রে দেখা দেয় না। যেমন-
- খাবারে স্বাদ পাবে না
- কোনো কিছুর গন্ধ পাবে না
- চোখ লাল হয়ে যাবে
- গলা ব্যথা
- মাথা ব্যথা
- মাংস্ পেশি এবং জয়েন্টে ব্যথা
- শরীরে বিভিন্ন ধরনে রেশ দেখা যাবে
- বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া
- ডায়রিয়া
- মাথা ঘুরা ইত্যাদি ।
লক্ষনে দেখে কোভিড-১৯ সনাক্ত করা সম্ভব নয়। তবে উপসর্গ গুলির মধ্যে অন্তত ২ট থাকলে অথবা মুখে স্বাদ বা নাকে গন্ধ না পেলে দ্রুত করোনা পরীক্ষা করুন। (WHO, 2020)
করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়ঃ
আমরা সকলে জানি যে, কোভিড-১৯ হয়ে থাকে SARS-CoV-2 নামক করোনা ভাইরাস দ্বারা। যা মানব দেহে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
- করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এই ভাইরাস হাঁচি, কাশি ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যের দেহে ছড়িয়ে পড়ে । এছাড়াও কথা বলার সময়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
- বর্তমান গবেষণা গুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, ভাইরাসটা মূলত ছড়ায় একে অপরের খুব কাছাকাছি থাকলে। সাধারণত ১ মিটার বা ৩ ফুটের মধ্যে থাকলে ।
- করোনা ভাইরাস কোনো ব্যক্তিকে তখন আক্রান্ত করতে পারবে যখন, আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির সাথে বের হওয়া এরোসল বা ড্রোপলেট ঐ ব্যক্তির চোখ, নাক এবং মুখ দিয়ে ঢুকবে।
- করোনা ভাইরাস জনবহুল এলাকায় সহজে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারন হাঁচি, কাশির সাথে বের হওয়া এরোসল গুলো আক্রান্ত ব্যক্তির বা সন্দেহভাজন লোকের আশেপাশের ১ মিটারের মধ্যে থাকে।
- এছাড়া এমন কোনো স্থান, যেখানে করোনা ভাইরাস লেগে আছে তা স্পর্শ করলে এবং হাত পরিষ্কার না করে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করলে করোনা ভাইরাস দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়। (WHO, 2020)
করোনা সনাক্ত হলে করনীয়ঃ
রোগীর মৃদু উপসর্গ হলে কি করনীয়-
- কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী/রোগীর সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি ১৪ দিন পর্যন্ত আইসোলেশনে থাকবেন চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সময়সীমা বেশি বা কম হতে পারে।
- রোগীকে আলাদা কক্ষ ও আলাদা শৌচাগার ব্যবহার করতে হবে।
- রোগীর তৈজসপত্র যেমন-থালা, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি, তোয়ালে, বিছানার চাদর ইত্যাদি অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবেনা।
- রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
- রোগীকে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন-সি যুক্ত ফল যেমনঃ লেবু, কমলা, মাল্টা, আমলকি প্রভৃতি খেতে হবে।
- একটি থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
- যদি নতুন উপসর্গ দেখা দেয় বা আগের উপসর্গের অবনতি হয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। (BD.GOV, 2020)
রোগীর মাঝারি উপসর্গ হলে কি করনীয়-
- কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী/রোগীর সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি ১৪ দিন পর্যন্ত আইসোলেশনে থাকবেন চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সময়সীমা বেশি বা কম হতে পারে।
- রোগীকে আলাদা কক্ষ ও আলাদা শৌচাগার ব্যবহার করতে হবে।
- রোগীর তৈজসপত্র যেমন-থালা, গ্লাস, কাপ ইত্যাদি, তোয়ালে, বিছানার চাদর ইত্যাদি অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করা যাবেনা।
- রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
- রোগীকে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ভিটামিন-সি যুক্ত ফল যেমনঃ লেবু, কমলা, মাল্টা, আমলকি প্রভৃতি খেতে হবে।
- একটি থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
- পালস অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
- উপুর হয়ে শোয়া, নিতান্ত রোগী উপুর হতে না পারলে পাশ ফিরে শোয়া।
- ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা।
- দিনে ২-৪ বার নিঃশ্বাসে গরম পানির ভাপ নেয়া।
- দিনে অন্তত ২/৩ কাপ গরম মসলা চা খাওয়া।
- দিনে একবার নাকে কালিজিরা ভিজানো পানির ড্রপ নেয়া।
- কালিজিরা, রসুন, মধু ইত্যাদি খাওয়া। (BD.GOV, 2020)
রোগির তীব্র উপসর্গ হলে কি করনীয় –
- রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রইয়োজনে ICU তে স্থানান্তরিত করতে হবে। (BD.GOV, 2020)
করোনা পরবর্তী উপসর্গ এবং করনীয়-
উপসর্গ-
- ক্লান্তি
- নিশ্বাস নিতে কষ্ট
- স্নায়বিক জটিলতা
- ঘুমের সমস্যা
- কথা মনে রাখতে কষ্ট হওয়া/ মনযোগে সমস্যা
- কাশি
- পেশীতে ব্যাথা বা মাথা ব্যাথা
- হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে যাওয়া
- বিষন্নতা/ উদ্বিগ্নতা
- র্যাশ হওয়া
- চুল পড়া
- মুখে স্বাদ না থাকা
- নাকে গন্ধ না পাওয়া
করনীয়-
- দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন। (BD.GOV, 2020)
ডায়াগনোসিসঃ
করোনার লক্ষণ দেখার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব করোনার টেস্ট করা উচিৎ। এছাড়া ঐ সকল ব্যক্তিকেও করোনার টেস্ট করতে হবে যারা, করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এমন ব্যক্তির সেবা যত্ন করেছেন বা কাছাকাছি ছিলেন। সাধারণত PCR টেস্ট নির্ভুল হয়ে থাকে। (WHO, 2020)
করোনায় রোগীর অক্সিজেনের কেন প্রয়োজন ?
মানুষ সর্বোচ্চ ৩ মিনিট অক্সিজেন ছাড়া থাকতে পারে। তার বেশি সময় যদি অক্সিজেন ছাড়া থাকে তাহলে মস্তিস্ক যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে সেটা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। ফুসফুস মানব দেহের একমাত্র গ্যাস বিনিময় অঙ্গ । করোনা ভাইরাস মানব দেহের ফুসফুসে প্রদাহের সৃষ্টি করে। এতে গ্যাস বিনিময়ের সমস্যা হয়। মিঊকাস বা শ্লেষ্মা নির্সরনের পরিমান অনেক বেড়ে যায় এতে ফুসফুসের সূক্ষ নালি গুলো অক্সিজেন প্রবাহে বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে অক্সিজেন বিনিময়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে নিওমোনিয়া, এআরডিএস, হাইপোক্সিয়া ,অ্যাকিউট কার্ডিয়াক ইনজুরির মতো জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এতে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এজন্য অক্সিজেন থেরাপীর মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের পরিমান বাড়ানো হয় যাতে সব অঙ্গে কার্যক্ষমতা অটুট থাকে।
পরামর্শঃ
- কাশি বা হাচি দেয়ার সময় কনুই ভাজ করে নাক মুখ ডাকতে হবে।
- মাস্ক সঠিক নিয়মে ব্যবহার করতে হবে।
- শরীরের তাপমাত্রা এবং আক্সিজেনের মাত্রা ৬ ঘন্টা অন্তর পরিমাপ করতে হবে।
- পর্যাপ্ত পরিমান পানি পান করতে হবে।
- বার বার সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে সঠিক নিয়মে হাত ধৌত করতে হবে। অথবা ৭০ ভাগ আলকোহল যুক্ত হ্যান্ড স্যনিটাইজার ব্যাবহার করতে হবে।
- কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
- হতাশা, ঊদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না। মনকে কর্মব্যস্ত ও উৎফুল্ল রাখতে হবে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহারকৃত জিনিস সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারবে না।
- আলো বাতাস যুক্ত স্থানে অবস্থান করতে হবে।
- সাইট্রাস সমৃধ ফল খেতে হবে।
- দ্রুত ভ্যাক্সিন গ্রহণ করুন।
- ওষুধ গ্রহনের পাশাপাশি রোগীকে ফিজিওথেরাপীর চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর মৃত্য ঝুকি কমানো সম্ভব।
- এছাড়া করোনার পরবর্তী উপসর্গ গুলোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিতসকদের পরামর্শ ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
References
BD.GOV, C. i., 2020. Corona Info Gov. BD. [Online]
Available at: https://corona.gov.bd/
[Accessed 29 March 2020].WHO, T., 2020. World Health Organigation. [Online]
Available at: https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/question-and-answers-hub/q-a-detail/coronavirus-disease-covid-19
[Accessed 13 May 2021].